একটি বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আমার মনের মাধূরী মিশিয়ে এই গল্প লেখার প্রয়াস।
গত শতাব্দীর কথা। ছোট্ট একটি ১০ বছরের মেয়ে। নাম তার আলেয়া বেগম। গ্রামের সবাই তাকে আদর করে “আলো” বলে ডাকে। সারা গ্রামে সে ঘুরে বেড়ায়। একটু চঞ্চল,একটু পাগলামি, দৌড়াদৌড়ি,ছুটাছুটি,হা-ডু-ডু,লুকোচুরি সবই আছে তার স্বভাবে। কিছু জিজ্ঞেস করলে মনে হয় মুখে খৈ ফুটে। একটা কথার জবাবে ১০টি কথা বলে। তারপরও সবাই তাকে ভালবাসে। পাড়ার লোকের চোখের মণি সে। একদিন এই গ্রামের অতিথি হয়ে এলো এক যুবক। বয়স হয়তো ১৫ কিংবা ১৭।
আশি কিংবা একশত বছর আগে বিয়ের উপযুক্ত বয়স ছিল এটাই। ছেলেটির জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে। বিদেশ ফেরত,ভাল বংশ এবং টুক-টাক লেখা-পড়া জানে। আগের যুগের জন্য সে ছিল হিরো। সে গ্রামে ঘুরার সময় দেখল দীঘির পানিতে একপেড়ে শাড়ী পড়া একটি মেয়ে। একমনে গুণগুণ করছে,আর শাপলা উঠাচ্ছে। ছেলেটি একটি গাছের আড়ালে গিয়ে মেয়েটিকে চুপিসারে দেখতে লাগল, কেউ যেন তাকে দেখে না ফেলে। মেয়েটি অনেকগুলো ফুল তুলল। ফুলগুলি দিঘীর পাড়ে সযত্নে রেখে সে তার সাথীদের ডাক দিল। ২/৩ জন এদিক ওদিক থেকে ছুটে এল। সবাই মিলে দিঘীর জলে সাঁতরাতে লাগল। আলোর চেহারাটা ছিল মায়াবী। এই মিষ্টি মেয়ের চঞ্চলতা, দীঘির জলে ডুবাডুবি-যুবকটির খুবই মনে লাগল। সে এমনই তন্ময় হয়ে দেখছিল যে - মেয়েটি কখন চলে গেল সে টেরই পেলনা। যখন ঘোর কাটল দেখল সে-মেয়েটি তার এত সাধের ফুল গুলিই রেখে গেল ভুলে। ছেলেটি ভাবল-নিশ্চয় মেয়েটি আবার আসবে ফুল নিতে। অনেক্ষণ বসে রইল অধীর অপেক্ষায়। কিন্তু আলেয়ার আলো আর চোখে পড়ছেনা। অগত্যা ফুলগুলি নিয়ে ছেলেটি যে বাড়িতে বেড়াতে এসেছে সে বাড়িতে গেল। বাড়িতে গিয়ে সে তো আরেকবার হুছট খেল। তার কল্পনার রানী বারান্দায় বসে বড়ই খাচ্ছে। অর্থাৎ এই বাড়িরই মেয়ে সে। অচেনা লোকের হাতে শাপলা ফুল দেখে আলো একটু অবাক হলো। ছেলেটি ফুলগুলি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল- তোমার ফুল। মেয়েটি হঠাৎ খুব লজ্জা পেল নিজের বোকামির জন্য। ফুলগুলি নিয়ে সে দৌড়ে পালাল। ছেলেটি আলোকে নিয়ে এতই বিভোর ছিল যে, বাড়িতে গিয়েও তার আর কিছুই ভাল লাগছিলনা। শুধুই আলোর সেই সাঁতারের দৃশ্য, আলোর ফুল তুলা, লজ্জা পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য তার মনে ভেসে বেড়াতে লাগল। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এরই মধ্যে তার মা তার বিয়ের জন্য কয়েকটি মেয়ের খবর নিয়ে এলো। সে বলল আলেয়ার কথা। আলেয়া তো তাদেরই আত্নীয়া। সবারই আলোকে পছন্দ কিন্তু বয়সটা যে কম। সে তো বিয়ে স্বামী কিছুই বুঝবেনা। ছেলের এক কথা- সে আলোকেই বিয়ে করবে। তার কথারই জয় হল। ধূমধাম করে আলেয়া বেগমের বিয়ে হয়ে গেল। আলো শ্বশুড় বাড়ীতে এসে একেবারে চুপ হয়ে গেল। তার যেন কিছুই ভাল লাগছেনা। নতুন স্বামীকেও না। তার সাথীদের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে পাড়াময় ঘুড়ে বেড়ানো, কিছুতেই যেন তার মন বসেনা। বিয়ের তিনদিন পর স্বামীর ঘরে তাকে পাঠানো হল। স্বামী সাহেবতো অনেক স্বপ্নের বীজ বুনছিল বসে বসে। আর অনেক স্বপ্নের বউটিকে কাছে পেয়ে তার মন চাইল আলেয়ার আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে। শাপলার মত নরম তুলতুলে গাল গুলোতে একটু ঠোটের পরশ দিতে। আলোকে নিয়ে সে খুব রোমান্টিক ইমেজে ছিল। কিন্তু যেই তার লক্ষি বউটিকে একটু ধরতে গেল অমনি সে ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। তাদের বাড়ীর সেই ছেলেটিই যে তার স্বামী তাও সে জানতনা। আগেকার যুগে এসব জানারও প্রয়োজন ছিলনা। যাক্ সেই কথা,আলোর কান্না শুনে শ্বাশুড়ী -জা ছুটে এল। ঘরে ঢুকেই দেখল -ছেলেটি লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দাড়িয়ে আছে আর মেয়েটিতো বাচ্চা মেয়ের মত কেদেঁই চলেছে স্বামীর একটু ছোঁয়াতেই। শ্বাশুড়ী সব বুঝলেন। ছেলেকে বললেন-আমি আগেই জানতাম এমনটি হবে। তারপর আলোকে নিয়ে তিনি নিজের ঘরে চলে এলেন। অনেক বুঝালেন। নাহ্-আলো যেন কিছুই বুঝেনা। স্বামী বেচারা বড্ড অভিমানে বিয়ের এক সপ্তাহ পড়েই পাড়ি জমাল। এদিকে আলো যেন হাফ ছেড়ে বাচঁল। সে ভীষণ খুশী হল -আপদ বিদায় হওয়াতে। কিন্তু সে এতটুকু বুঝল যে, শ্বশুড় বাড়ির সবাই মনে কষ্ট পেল। তাকে কেউ কিছু বলছেনা। তারপরও তার মনে হচ্ছিল যে, তার জীবনে একটা অঘটন ঘটে গেল। একটা পরিবর্তন আসল। আলো কিছুদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে গেল। নিজের বাড়িতে আর শ্বশুড় বাড়িতে ঘুড়ে বেড়াতে লাগল। তার বিবাহিত চাচাতো বোন তাকে একদিন স্বামীর গল্প বলছিল। সেও শুনছিল। কথায় কথায় বোনটি বলল-কিরে তোর স্বামীর খবর কি? আলোর মনে একটু শিহরণ খেলে গেল। সে কিছুই বলল না। আসলে এই মেয়েটিকে আলোর শ্বাশুড়ি নিয়োগ করেছে-যেন স্বামীর গল্প শুনে শুনে আলোর মনে নিজের স্বামীর জন্য ভাবের উদ্বেগ হয়। এভাবে কেটে গেল পাঁচটি বছর। আলোর বয়স এখন পনের। চাচাতো বোনের কাছে স্বামীর গল্প শুনতে শুনতে তার মন এখন মাঝে মাঝে স্বামীর জন্য চঞ্চল হয়। ঘুমের ঘোরে সে স্বপ্ন দেখে হঠাৎ ঘুম ভেংগে যায়। বাসর ঘরে সে স্বামীর সেই প্রথম স্পর্শের কথা বারবার মনে পড়ে। বাসর ঘরেতো স্বামীর চেহারার দিকে সে তাকায়নি ভাল করে। কিন্তু বিয়ের আগে তাদের বাড়িতে শাপলা ফুল হাতে সেই যুবকটি কিভাবে জানি তার মনে ঠাঁই করে নিল কিভাবে যে কি হল সে কিছুই বুঝতে পারছেনা। তার এমন কেন লাগে? তার স্বামীকেই সে দোষ দেয়, সে আসলেই তো পারে। আমার না হয় ভুল হয়ে গেছে-আমি বুঝতে পারিনি। সে তো বুঝে। সে কেন আসেনা? আমার ভুলতো ভেংগেছে। এভাবে নিজের মনে অনেক কথাই বলে চলে আলো। শ্বাশুড়ি আর জা আলোর এই পরিবর্তনে খুবই খুশি। চিঠিতে সব জানালেন ছেলেকে। অভিমান করে সে যে গেছে ছেলের আর পাত্তা নেই। দীর্ঘ ছয় বছর পর ছেলেটির মন আবারো চঞ্চল হয়ে উঠল আলোর জন্য। ফিরে এলো সে নতুন প্রেমের টানে। বাড়িতে এসে সবাইকে দেখল কিন্তু যার জন্য তার মন ব্যাকুল তাকে সে দেখছেনা। লজ্জায় কিছু বলছেওনা। রাত্রিবেলা সবাই ঘুমাতে চলে গেল নিজেদের ঘরে। সেও নিজের ঘরে চলে গেল। ভাবল-আমি এসেছি অথচ আলো তার বাপের বাড়িতে বসে আছে-এই তার পরিবর্তন! নাহ,আমার আসাটাই বৃথা হল। ঘরে ঢুকেতো সে অবাক! তার হার্টবিট বেড়ে গেল। একি শুধুই স্বপ্ন নাকি সত্যি! সে দেখল এক নারী নববধূর সাজে লম্বা ঘোমটা টেনে জড়সড় হয়ে তার খাটে বসে আছে। সে কাছে গেল। আল্লাহকে অনেক শোকরিয়া জানাল। মনে হল তার মনের সব হাহাকার এক মূহুর্তে শেষ হয়ে গেল। আনন্দে আত্নহারা যুবক সযত্নে ঘোমটা খুলে দেখল-আহা! একি রূপ,একি মাধূর্য! আগের সেই ছোট্ট আলো নয় সে। সে এখন পরিপূর্ণ যুবতী। মনে মনে স্বামী বলল, এইতো ভাল হলো। প্রথম বাসরের বাচ্চা মেয়েটি বাচ্চাদের মতই কান্নাকাটি করত। আর দ্বিতীয় বাসরের বউটি যেন - তারই আলিঙ্গনের অপেক্ষায় চোখ বুঝে প্রহর গুণছে। দুজনই আবেগে আপ্লুত, কারো মুখে কথা নেই। মনের মধ্যেই হচ্ছে সব কথার বিনিময়। তারপরও যুবক তার নিষ্পাপ নববধূর চেহারার দিকে তাকিয়ে হাত দুখানা নিজের হাতে নিয়ে বলল-কেমন ছিলে বউ? বউটি কিছুই বললনা। চোখদুটি অশ্রুসিক্ত হল। এই কান্না তার ভয়ের নয়, ভালবাসার কান্নায় সে নিজেকে জলাঞ্জলী দিল স্বামীর বুকে। এই বিলম্বিত বাসরে দুজনই মহাসুখী। তাদের এই মহা মিলনে উৎকন্ঠিত আলোর পরিবার ও পাড়া প্রতিবেশী সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
2 comments:
আপনার লেখা?
দারুন হয়েছে।
Hi!Thank u very much for ur nice comments.
Post a Comment